যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন তার সাম্প্রতিক বইয়ে প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে যেসব দাবি করেছেন, তা অন্য সব কিছুকে ছাপিয়ে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
বিশেষ করে বোল্টন তার সাবেক শীর্ষ পদের সুবাদে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ থাকার কারণে এবং তিনি যেসব দাবি করেছেন তার বিষয়বস্তুর নিরিখে চাঞ্চল্যকর।
বিবিসি বাংলা বলছে, বোল্টন তার দ্য রুম হোয়্যার ইট হ্যাপেন্ড (যে ঘরে এসব ঘটেছিল) শিরোনামের বইটিতে প্রেসিডেন্টকে তুলে ধরেছেন একজন অজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে, যার সাধারণ ভূ-রাজনৈতিক বিষয়ে জ্ঞানের অভাব রয়েছে এবং যিনি বেশিরভাগ সিদ্ধান্তই নেন নির্বাচনে আবার জিতে আসতে হবে এই তাড়না থেকে।
হোয়াইট হাউস বোল্টনের এই বইয়ের প্রকাশ বন্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু আমেরিকার সংবাদমাধ্যম এই বইয়ের অগ্রিম কপি হাতে পেয়ে গেছে। অনেক পত্রিকা এই বইয়ের অংশবিশেষ ছাপতেও শুরু করেছে।
আর সেসব প্রতিবেদন থেকে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বোল্টনের আনা সবচেয়ে মারাত্মক ১০টি অভিযোগ তুলে ধরা হলো-
১. দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হতে চীনের সাহায্য চেয়েছিলেন ট্রাম্প
এই বইয়ে বোল্টন গত বছর জাপানে জি-টোয়েন্টি সম্মেলনের সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের মধ্যে এক বৈঠকের কথা উল্লেখ করেছেন।
বইতে তিনি লিখেন, ‘প্রেসিডেন্ট হঠাৎ কায়দা করে আলোচনা ঘুরিয়ে ফেললেন আসন্ন (নভেম্বর ২০২০) আমেরিকান নির্বাচনের দিকে। চীনের বিরাট অর্থনৈতিক সক্ষমতার দিকে ইঙ্গিত করলেন এবং শি-কে অনুরোধ করলেন তার জেতা তিনি যেন নিশ্চিত করেন।’
‘কৃষকরা কত গুরুত্বপূর্ণ সেটার ওপর তিনি জোর দেন এবং নির্বাচনে সুবিধা পাওয়ার জন্য চীনে সয়াবিন ও গমের বিক্রি বাড়িয়ে দেন’ বইতে উল্লেখ করা হয়।
আমেরিকায় মিডওয়েস্টের রাজ্যগুলোতে কৃষি অন্যতম প্রধান একটা অর্থনীতি। এই রাজ্যগুলোই ২০১৬ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পকে জিততে সাহায্য করেছিল।
২. চীনের মুসলিম বন্দিশিবির তৈরি ‘সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল’
চীনে উইঘুর মুসলিম ও অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রায় ১০ লাখ মানুষকে শিনজিয়াং এলাকায় বন্দি শিবির তৈরি করে সেখানে আটক রেখে তাদের প্রতি চীনা সরকার যে আচরণ করে, তা নিয়ে বিশ্ব জুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছিল।
চীনা কর্তৃপক্ষের গণহারে মানুষকে আটক রাখার কারণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন চীনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা অনুমোদন করেন তখন চীন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখায়।
কিন্তু বোল্টন তার বইয়ে লিখেছেন, শি যখন ওই শিবির গঠনের পেছনে তার যুক্তি তুলে ধরেন, তখন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বলেন তিনি চীনের পদক্ষেপ সমর্থন করেন।
বোল্টন লিখেছেন, ‘আমাদের যে দোভাষী, তার ভাষায় ট্রাম্পের বক্তব্য ছিল- শি’র উচিত শিবিরগুলো তৈরির কাজে এগিয়ে যাওয়া। ট্রাম্প মনে করেন এটা একেবারে সঠিক কাজ।’
৩. ট্রাম্প একনায়কদের আনুকূল্য দিতে আগ্রহ দেখান
চীনা নেতাই একমাত্র একনায়ক নন, যার প্রতি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সমর্থন দিতে আগ্রহ দেখিয়েছেন।
বোল্টন লিখছেন, ট্রাম্প যেসব স্বৈরশাসকদের পছন্দ করেন তাদের ব্যাপারে ফৌজদারি তদন্তে নাক গলাতে তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন যাতে ওইসব তদন্তে শাসকরা তার ব্যক্তিগত আনুকূল্য পান।
বইতে বলা হয়, ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা লংঘনের অভিযোগে ২০১৮ সালে তুরস্কের একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমেরিকায় যখন তদন্ত চালানো হয়, তখন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ানকে তিনি সাহায্য করার প্রস্তাব দেন।
প্রেসিডেন্ট বলেন, তিনি নিজে ‘সব কিছু দেখবেন’ এবং ওই তদন্ত কাজে যারা কৌঁসুলি ছিলেন তারা ‘ওবামার লোকজন’।
৪. ট্রাম্পের অভিশংসন প্রয়াস নিয়ে ডেমোক্রাটদের আরও এগোনো উচিত ছিল
বইয়ে বোল্টন ডেমোক্রাটদের সমালোচনা করেছেন এই বলে যে, শুধু ইউক্রেনের বিষয়টি সামনে এনে তারা ‘ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়ার অপব্যবহার’ করেছে।
তিনি যুক্তি দিয়েছেন, তারা যদি তদন্তের পরিসর আরও ব্যাপক করত, তাহলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ‘বিভিন্ন মাত্রার অপরাধ ও অন্যায়’র জন্য আইনত ক্ষমতা থেকে অপসারণের পেছনে তারা আরো অনেক বেশি আমেরিকানের সমর্থন পেতেন।
গত বছরের শেষ দিকে যখন হাউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভে এই অভিশংসনের শুনানি চলছিল, তখন বোল্টন সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করেন। পরে সিনেটের রিপাবলিকান সদস্যরা তাকে শুনানি দিতে বাধা দেয়।
৫. দুই মেয়াদের বেশি ক্ষমতায় থাকতে চান ট্রাম্প
ট্রাম্প চীনা নেতাকে বলেছিলেন যে, তিনি যাতে দুই মেয়াদের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেন, তার জন্য প্রয়োজনীয় সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে আমেরিকানরা খুবই আগ্রহী।
‘বিষয়টা সামনে এসেছিল, যখন শি বলেন তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে আরও ছয় বছর একসঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। তখন ট্রাম্প জবাব দেন, জনগণ বলছে প্রেসিডেন্টের দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার যে বিধি সংবিধানে আছে তা তার জন্য বাতিল করে দিতে’ একথা বোল্টন লিখেছিলেন ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক নিবন্ধে।
তার দাবি, ‘শি বলেছিলেন আমেরিকায় খুব বেশি নির্বাচন হয়, কারণ তিনি ট্রাম্পের জায়গায় আর কাউকে দেখতে চান না। ট্রাম্প মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিলেন।’
৬. ট্রাম্প জানতেন না যুক্তরাজ্য পরমাণু শক্তিধর
আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পর ১৯৫২ সালে ব্রিটেন ছিল তৃতীয় দেশ যারা আণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটায়। কিন্তু পরমাণু অস্ত্রধর স্বল্প কয়েকটি দেশের যে গোষ্ঠী রয়েছে, ব্রিটেন যে তার অংশ ট্রাম্প নাকি সেটা জানতেন না।
বইয়ের একটি অংশে ২০১৮ সালে ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে’র সঙ্গে এক বৈঠকের কথা বলা হয়েছে, যেখানে একজন কর্মকর্তা ব্রিটেনকে পরমাণু শক্তিধর দেশ বলে উল্লেখ করেন।
বলা হচ্ছে ট্রাম্প তখন উত্তর দেন, ‘ওহ! আপনার দেশে পরমাণু অস্ত্র আছে বুঝি?’ বোল্টনের কথায়, ‘তিনি (ট্রাম্প) মজা করে একথা বলেননি।’
৭. ফিনল্যান্ড রাশিয়ার অংশ কিনা
বোল্টন বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জ্ঞানের ক্ষেত্রে আরও দুর্বলতা রয়েছে। ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকিতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে এক বৈঠকের আগে ট্রাম্প জিজ্ঞেস করেছিলেন, ফিনল্যান্ড ‘রাশিয়ার এক ধরনের উপরাষ্ট্র’ কিনা।
৮. ন্যাটো থেকে আসলে বেরিয়েই আসছিলেন ট্রাম্প
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ন্যাটো সামরিক জোটের সমালোচক ছিলেন বরাবর। তিনি অন্য সদস্য দেশগুলোকে তাদের তহবিল বাড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছিলেন। বোল্টনের দাবি, ২০১৮য় ন্যাটোর এক শীর্ষ বৈঠকে ট্রাম্প সিদ্ধান্ত নেন যে আমেরিকা ন্যাটো থেকে বেরিয়ে যাবে।
‘আমরা বেরিয়ে যাব এবং যারা অর্থ দেয় না তাদের পক্ষে আমরা থাকব না’, প্রেসিডেন্ট এমনটা বলেছিলেন বলে লিখেছেন বোল্টন।
৯. ভেনেজুয়েলা আক্রমণ ‘দারুণ’ ব্যাপার হবে
ট্রাম্প প্রশাসনের বিদেশ নীতি নিয়ে অন্যতম বড় একটা মাথাব্যথার বিষয় ছিল ভেনেজুয়েলা। আর আমেরিকা দেশটির প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর কট্টর বিরোধী।
এই দেশটি প্রসঙ্গে আলোচনায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ভেনেজুয়েলা আক্রমণ করলে ‘দারুণ’ হবে। আর দক্ষিণ আমেরিকার দেশটি ‘আসলে কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই অংশ’।
১০. মিত্ররা ট্রাম্পকে নিয়ে মশকরা করেন
বোল্টনের বইয়ে বেশ কিছু উদাহরণ রয়েছে যেখানে হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নিয়ে মশকরা করার উল্লেখ রয়েছে।
তিনি একটা অকার্যকর হোয়াইট হাউসের বর্ণনা দিয়েছেন, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী বৈঠকগুলো আসলে ‘খাওয়া-দাওয়ার পার্টি’ হয়ে দাঁড়ায়।
যখন তিনি হোয়াইট হাউসে আসেন, সেই সময়কার স্টাফ প্রধান জন কেলি তাকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন এই বলে, ‘এটা কাজ করার জন্য খুবই নিকৃষ্ট জায়গা, তুমি নিজেই টের পাবে।’
এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও প্রেসিডেন্টকে ‘ফুল অব শিট বা মাথা ভর্তি গোবর’ বলে একটি নোটে উল্লেখ করেছিলেন বলে এই বইয়ে দাবি করা হয়েছে।
সংবাদ২৪/এসডি